মরমী লোকসঙ্গীত শিল্পী আব্দুল আলীম এক বিস্ময়কর প্রতিভা
মরমী লোকসঙ্গীত শিল্পী আব্দুল আলীম এক বিস্ময়কর প্রতিভা/ মোহাম্মদ সাদউদ্দিন
----------------------------------------
আব্বাসউদ্দিনের পর লোকসঙ্গীত জগতের আরেক বিশ্বনন্দিত লোকসঙ্গীত শিল্পী হলেন আব্দুল হালিম। তার এই লোকসঙ্গীতের ধারায় এসেছে পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি , মুর্শিদি ও আরো লোকজ উপাদান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশিদূর নয়। কিন্তু মরমী কন্ঠের যাদুতে আজো তিনি বাঙালি ও বাংভাষী মানুষের কাছে আজো জনপ্রিয় । ঢাকা সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের লোকসঙ্গীতের অধ্যাপক । সেই আব্দুল আলিম আমাদের কাছে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। ছোটো বেলায় আমরা যখন রেডিও বাংলাদেশ বা গ্রামফোন রেকর্ডে শুনতাম , দুয়ারে আইসাছে পাল্কি, দোল দোল দোলানি, সোনালি বরণ হলুদিয়া পাখি /পাখিটা ছাড়িল কে, এ সংসারে কেউ নয় আপনজনা, নবী মোর পরশমণি নবী মোর সোনার খনি , সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা /তোমার বেলায় নেব সখী তোমার কানের সোনা , ইত্যাদি গানগুলি যখন বেজে উঠতো তখন আপ্লুত হয়ে যেতাম। সেই আব্দুল আলিম মুর্শিদাবাদে সালার থানার (সাবেক ভরতপুর থানা) তালিবপুরের ভূমিপুত্র। ঐ গ্রামেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই। ৯৫তম জন্মদিন। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে আলিম মারা যান ১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর।
অবিভক্ত বঙ্গ ও বাংলাদেশের লোক সঙ্গীতের একজন ক্ষণজন্মা ও মরমী শিল্পী। মাত্র ৪৩ বৎসর উনি আমাদের মধ্যেই বেঁচে ছিলেন। যিনি লোক সঙ্গীতকে অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে জীবন জগৎ এবং ভাববাদী চিন্তা একাকার হয়ে গিয়েছিল। আবদুল আলীমের জন্ম ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই। তিনি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের (ভারত) মুর্শিদাবাদের তালিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকেই আলিম সঙ্গীতের প্রবল অনুরাগী ছিলেন। অর্থনৈতিক অনটনের কারণে কোনো শিক্ষকের কাছে গান শেখার সৌভাগ্য তার হয়নি। তিনি অন্যের গাওয়া গান শুনে গান শিখতেন; আর বিভিন্ন পালা পার্বণে সেগুলো গাইতেন। এভাবে পালা পার্বণে গান গেয়ে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
বাবার নাম ছিল মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। প্রাইমারি স্কুলে পড়বার সময় গ্রামোফোন রেকর্ডে গান শুনে গান গাইবার জন্য আগ্রহ জন্মে। ছোটবেলায় তার সঙ্গীত গুরু ছিলেন সৈয়দ গোলাম আলী। ওরফে অলু মিঞা। ব্রিটিশ ভারতের কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র সৈয়দ বদরুদ্দোজার বড়ভাই অলু মিঞা। কলকাতাতে আনার ক্ষেত্রে বদরুদ্দোজা ওরফে বদল মিঞার ছিল ইতিবাচক ভূমিকা।
অল্প বয়স হতেই বাংলার লোক সঙ্গীতের এই অমর শিল্পী গান গেয়ে নাম করেছিলেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে ১৯৪৩ সালে তার গানের প্রথম রেকর্ড হয়। রেকর্ডকৃত গান দুটি হলো "তোর মোস্তফাকে দে না মাগো" এবং "আফতাব আলী বসলো পথে"। এত অল্প বয়সে গান রেকর্ড হওয়া সত্যিই বিস্ময়কর। পরে তা আর বিস্ময় হয়ে থাকেনি, তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার লোক সঙ্গীতের এক অবিসংবাদিত-কিংবদন্তি পুরুষ। তার সাত সন্তানের মধ্যে তিন সন্তান জহির আলীম, আজগর আলীম ও নূরজাহান আলীম সঙ্গীত শিল্পী।
পরবর্তীকালে তিনি কলকাতায় যান এবং সেখানে আব্বাসউদ্দিন , কানাই লাল শীল ও কাজী নজরুল ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে গান করেছেন। তিনি লোক ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উপর দীক্ষা নিয়েছেন বেদারউদ্দিন আহমদ, ওস্তাদ মোহাম্মদ খসরু, মমতাজ আলী খান, আব্দুল লতিফ, কানাইলাল শীল, আব্দুল হালিম চৌধুরী প্রমুখের কাছে। লেটো দলে, যাত্রা দলে কাজ করেছেন।
দেশ বিভাগের পরে আব্দুল আলীম ঢাকায় চলে আসেন এবং রেডিওতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে গান গাইতে শুরু করেন। তিনি পরে টেলিভিশন সেন্টার চালু হলে সেখানেও সঙ্গীত পরিবেশন শুরু করেন। এছাড়াও তৎকালীন বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ সহ বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে আব্দুল আলীম গান করেছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রটি হলো ‘লালন ফকির’। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০টির মতো গান রেকর্ড হয়েছিল তার। আব্দুল আলীম তার আধ্যাত্মিক ও মরমী মুর্শিদী গানের জন্য অমর হয়ে থাকবেন। কবি ও বাংলার লোক সঙ্গীতের গবেষক কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, "সমাজাটকে যাঁরা জাগিয়েছেন আব্দুল আলীম তাঁদের একজন"। পেশাগত জীবনে আবদুল আলীম ছিলেন ঢাকা সঙ্গীত কলেজের লোকগীতি বিভাগের অধ্যাপক।
আব্দুল আলীম বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন; এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে একুশে পদক, পূর্বাণী চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার। পাকিস্তান মিউজিক কনফারেন্স, লাহোরে সঙ্গীত পরিবেশন করে আব্দুল আলীম পাঁচটি স্বর্ণ পদক পেয়েছিলেন।বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৭ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে সম্মানিত করে।
আজ শ্রদ্ধেয় আবদুল আলীমের ৯৫-তম জন্মদিন।
জন্মদিনে এই মরমী শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা ও অপরিসীম ভালোবাসা জানাই।