চারণকবি গুমানী দেওয়ান ও কিছু কথা/মোহাম্মদ সাদউদ্দিন:
বাংলা লোকসাহিত্য ও লোক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কবিগান, কবিয়াল বা চারণকবিদের ঐতিহাসিক ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর সেই কারণেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রণেতাগণ তাদেরকে উপেক্ষা করতে পারেননি। যেমন লেটো, আলকাপ, পঞ্চরস, সত্যপীরের গান, ফকিরি গান, কীর্তন গান, শব্দের গান আমাদের লোকসংস্কৃতির এক একটা অঙ্গ। যদিও ধীরে ধীরে এই সংস্কৃতিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। তবুও বলব কবিগান আজো জাগ্রত বঙ্গের মানুষের কাছে। যদিও তারও গতি কিছুটা হলেও রুদ্ধ হচ্ছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমাদের এই বঙ্গে কবিগানের চলন। যদিও তার জন্ম-ইতিহাস অনেক প্রাচীন। এন্টোনি ফিরিঙ্গি-ভোলা ময়রা, গুমানী-লম্বুদোর, চাঁদ মহম্মদ-দেবেন চাঁই(দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরি), রামনিধিগুপ্ত, প্রমুখ চারণকবি আজো বঙ্গের পথেপ্রান্তরে জনপ্রিয়। কলকাতা মহানগরীর বৌবাজারের ফিরিঙ্গি হাউস চারণকবি এন্টোনি ফিরিঙ্গর কথা জানিয়ে দেয়। এন্টোনি ফিরিঙ্গির প্রকৃত নাম হান্স ফিরিঙ্গি। পর্তুগালের ভূমিপুত্র হয়েও তিনি বাংলাকে ভালো বেসেছিলেন। আর বাগবাজারে গেলে ভোলা ময়রার কথা চলে আসে। তিনি ছিলেন হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার সন্তান।
এইরকম আরেক বিখ্যাত চারণকবি বা কবিয়াল ছিলেন গুমানী দেওয়ান। ইনি ছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুর মহকুমার সাগরদীঘি থানার জিনদীঘি গ্রামের সন্তান । গুমানী দেওয়ান ১৩০২ বঙ্গাব্দের ২১ ফাল্গুন(১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ মার্চ) জন্মগ্রহণ করেন। মারা যান ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ২৬ বৈশাখ(১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ মে)। কথিত এটাই যে, জিনেরা একরাতে দীঘিটা তৈরি করেছিল বলে গ্রামের নাম জিনদীঘি। এই দীঘির ধারেই রয়েছে মা মেহেরুন্নিসার মাজার। দীঘির দক্ষিণে রয়েছে এক ইরাকি পীরের মাজার। সাগরদীঘি বঙ্গের তুর্কি সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ -র নানান স্মৃতি রয়েছে। জিনদীঘির পাশ দিয়ে চলে গেছে বাদশাহ হোসেন শাহের নির্মিত বাদশাহী সড়ক। এই জিনদীঘিতে কালীমন্দির রয়েছে। বামাক্ষ্যাপার মতো সাধক এখানে এসেছেন। গুমানি দেওয়ানের পিতার নাম মালিয়াত দেওয়ান ও মায়ের নাম আসমানি বিবি(আরমানি বিবি)। এদের চার ছেলে ও এক মেয়ে। এরা হলেন সোলেমান দেওয়ান, ওসমান দেওয়ান, গুমানী দেওয়ান ও ইমানী দেওয়ান। মেয়ের নাম মেওয়া দেওয়ান।
গুমানির দুটো বিয়ে। প্রথম স্ত্রীর গর্ভের এক মেয়ে যারা জিনদীঘির সঙ্গে আর সম্পৃত্ত নয়। দ্বিতীয় স্ত্রী হিন্দু মেয়ে।নাম দানি। পরবর্তী নাম হয় হেদায়েতুন্নেসা। এই দ্বিতীয় স্ত্রীর এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলের নাম শেখ কামরুজ্জামান (বাদল দেওয়ান) ও মেয়ের নাম লতিফা দেওয়ান(লতা)।
বাদল দেওয়ান ওরফে কামরুজ্জামানের ছেলের নাম উজ্জ্বল দেওয়ান। মেয়ে লতিফা বা লতার ছয় ছেলে ও দুই মেয়ে। এদের নাম যথাক্রমে মণি, মানিক, বকুল, সুকুল, মঞ্জু , সজল গিনি ও রূপা।
ইরাকের নাজাফ শহর থেকে গুমানি দেওয়ানের বংশধররা আসেন। তার পিতা মালিয়াত দেওয়ান জিনদীঘিতে আসেন জিয়াগঞ্জের সিংহ জমিদারদের দেওয়ান হিসাবে । সাগরদীঘিতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পালরাজাদের অনেক কীর্তি ছড়িয়ে রয়েছে। মহীপাল ছিল পাল রাজাদের বাণিজ্যিক রাজধানী। পরে মুসলিম শাসক ও পীর-ফকিরদের চরণচিহ্ণ পড়ে সাগরদীঘি ও জিনদীঘিতে। গুমানী দেওয়ানের পুঁথিগত বিদ্যা মাইনর (ষষ্ঠ শ্রেণী) পাশও নন। বন্যেশ্বর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক পাশ করে সেখানেই শিক্ষকতা করেন । যেমন নজরুল মখতবে পড়েই মখতবেই শিক্ষকতা করেন। এই বন্যেশ্বর ছিল গুমানীর উত্থানের কেন্দ্রবিন্দু। গুমানী ছেলেবেলায় শুনতেন রাখালদাস বাউলের গান। স্কুলে তরুণ চারণকবিদের এনে গান শুনতেন। কবিয়ালদের শিক্ষাকেন্দ্র স্হাপিত হয়েছিল জিনদীঘিতে। তারপর একে একে গুমানী দেওয়ান বিখ্যাত কবিয়াল বা চারণকবিতে পরিণত হন। কথিত এটাই যে, স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রতিভায় অভিভূত হয়ে যান।
এই গুমানী দেওয়ানকে নিয়ে প্রথম গবেষণা গ্রন্হ লিখেন সাহিত্যিক আব্দুর রাকিব। ১৯৬৮ সালে বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও গবেষক এবং হরফ প্রকাশনীর কর্ণধার আব্দুল আযীয আল আমান বের করেন । বইটির নাম "চারণকবি গুমানী দেওয়ান " । ২০০১ সালে পশ্চিমবঙ্গ লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সাহিত্যচর্চা কেন্দ্রের তৎকালীন চেয়ারম্যান মুজফফর হোসেন বইটা বের করেন। ২৪৬ পাতার পুস্তক এটি। আইএসবিএন নম্বর -৮১৮৭৩৬০৩৫৬।
গবেষণা তো একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। পরবর্তীতে তাকে নিয়ে গবেষণা গ্রন্হ অধ্যাপক শক্তিনাথ আই-এর " মধ্যবঙ্গের কবিগান:প্রসঙ্গ গুমানী দেওয়ান"(করুণা প্রকাশনী/কলকাতা) , অধ্যাপক কিশোরীরঞ্জন দাশের " বাংলার কবিগান"(দীপ প্রকাশনী), ড: আদিত্য মুখোপাধ্যায়ের রাঙামাটির গ্রাম(অমরভারতী), বাংলার লোকসংস্কৃতি(অমরভারতী), মাটির গান, শিকড়ের ঘ্রাণ(সৃশিক্ষা) ও লোকসংস্কৃতি, স্বরূপ ও সন্ধান(বোনা)।
গুমানি নিজেও তাঁর আত্মজীবনী লিখে গেলেও তা আজ কতখানি পাওয়া যাবে তা বলা কঠিন।
পূর্ব রেলের হাওড়া -ফারাক্কা শাখার (ভায়া রামপুরহাট-পাকুড়) গুমানী দেওয়ান নামে স্টেশন তাঁর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
একটা কথা না বললেই নয়। তিনি কবিতাও লিখতেন। কবিতা লেখার প্রবণতাও গুমানি দেওয়ানের মধ্যে ছিল। ছিল জীবনকে জানার। তাই তিনি জীবনের গভীরে ঢুকতেন। জীবনকে ছেনে খেয়েছেন। মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজার (এক সময়ের বন্দনগরী) রাজবাড়িতে তিনি কবিগান করতেন। কিন্তু তার সেই ইতিহাস আজ লুপ্ত। গুমানী দেওয়ানের মাধ্যমেই মধ্যবঙ্গের কবিগান লিখিত ইতিহাসের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠে। ১৯৪৬ সালের কলকাতার ভ্রাতঘাতী দাঙ্গার তিনি ও কবিয়াল রমেশ শীল কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় সম্প্রীতির আহ্বান জানিয়ে কবিগান করেন।তাতে সফল হন।