মুম্বাইয়ে কর্মরত শ্রমিকের মৃত্যু, গ্রামে দাফন নিয়ে সামাজিক বিতর্ক
দৌলতাবাদ, মুর্শিদাবাদ | ১৩ মে ২০২৫:
রাজমিস্ত্রি হিসেবে মুম্বাইয়ে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে কর্মরত ছিলেন মুর্শিদাবাদের দৌলতাবাদ থানার অন্তর্গত গঙ্গাপ্রসাদ গ্রামের বাসিন্দা জুয়েল খান (২৭)। পিতা মৃত আবেদুল খাঁন ও মাতা তর্জিনা বিবির সন্তান জুয়েল কিছুদিন পূর্বে কর্মবিরতিতে গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। প্রায় দেড় মাস গ্রামে কাটিয়ে পুনরায় কাজের উদ্দেশ্যে মুম্বাই ফিরে যান তিনি।
জানা গেছে, মুম্বাইয়ের আম্বলি থানা এলাকার আন্ধেরি আর.টি.ও অফিসের বিপরীতে অবস্থিত রয়েল বিল্ডিং-এ তিনি নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। গত ১১ই মে, রোববার, হঠাৎ দুপুরে প্রবল গরম ও রোদে কাজ করার সময় স্ট্রোক করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সহকর্মীরা তৎক্ষণাৎ তাকে স্থানীয় কুপার হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
জুয়েলের মৃত্যু সংবাদে পরিবারসহ গোটা গ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে। আম্বলি থানার পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় ও স্থানীয় সমাজসেবীদের প্রচেষ্টায় মরদেহটি মঙ্গলবার রাতেই গঙ্গাপ্রসাদ গ্রামের নিজ বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। তবে তার পরেই শুরু হয় এক সামাজিক জটিলতা।
স্থানীয় সমাজের রীতি অনুযায়ী, মদ্যপ, গাঁজাসেবী বা তথাকথিত ‘অসামাজিক’ লোকদের সামাজিক কবরস্থানে দাফন করার অনুমতি নেই। সম্প্রতি জুয়েল খান সম্পর্কে সমাজে কিছু নেতিবাচক ধারণা ছড়িয়ে পড়ায়, গ্রাম্য নেতৃবৃন্দ সামাজিক কবরস্থানে তার দাফনের অনুমতি দেননি। ফলে, বাধ্য হয়ে তার মামা সিরাজুল ইসলাম খাঁনের নিজস্ব আবাদ করা জমিতেই জুয়েলের দাফন সম্পন্ন হয়।
জুয়েলের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সমাজের এই সিদ্ধান্ত যেন কেবল জুয়েলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য না হয়, বরং ভবিষ্যতে এই নিয়ম যেন সবার জন্য সমভাবে প্রয়োগ হয়। তারা সমাজের এই আচরণে গভীর কষ্ট পেয়েছেন।
ঘটনাটি দৌলতাবাদ থানায় জানানো হলে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। তবে স্থানীয় সমাজপতিরা তাদের পূর্বঘোষিত সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। বর্তমানে পুলিশ প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের বৈষম্যমূলক ঘটনা যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।
স্থানীয় সমাজের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি—রাকিবুল খান ও মতলব খান সহ আরও অনেকে জানান, এই নিয়ম সম্প্রতি মাইকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামবাসীদের সম্মতি নিয়ে চালু হয়েছে এবং এর পেছনে সমাজকে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখার যুক্তিই প্রধান। তবে এই নিয়ম কাদের জন্য এবং কীভাবে প্রয়োগ করা হবে, তা নিয়ে গ্রামে এখন প্রশ্নের মুখে সেই সমাজপতিরাই।
অন্যদিকে, মৃত জুয়েলের আত্মীয়স্বজন এবং পরিবার এই সিদ্ধান্তকে অমানবিক ও পক্ষপাতমূলক বলে উল্লেখ করেছেন। জুয়েলের জিজা রাব্বিল আলামিন বলেন, “এ ধরনের নিষ্ঠুর আইন আমরা মেনে নিতে পারছি না। প্রয়োজনে কবরস্থান আলাদা করা যেতে পারে, কিন্তু তাই বলে সামাজিক দায়িত্ব থেকে পিছু হটা ঠিক নয়।”
জুয়েলের শোকে বিহ্বল বোন বলেন, “শুধু আমার ভাইয়ের বেলাতেই যদি এই সিদ্ধান্ত হয়, আর অন্যদের ক্ষেত্রে তা না হয়, তাহলে আমরা প্রতিবাদ করব—প্রয়োজনে ঝাঁটা নিয়ে তাড়িয়ে দেব।”
মা তর্জিনা বিবি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “এটা কেমন আইন? আমার ছেলে আজ সমাজে মাটির জায়গাও পেল না! অথচ সামাজিক অনুষ্ঠান বা উন্নয়নের নামে টাকা তো আদায় করা হয় পুরো গ্রামবাসীর কাছ থেকে।”
অবশেষে, জুয়েলের মামা সিরাজুল ইসলাম খান যিনি নিজের জমিতে ভাগ্নের দাফনের ব্যবস্থা করেছেন, তিনি জানান, “আজ আমার ভাগ্নের বেলায় যা হয়েছে, তা ভবিষ্যতে যেন আরও কারো সঙ্গে না হয়। সমাজের এই নিয়ম যদি থাকে, তাহলে তা সবার জন্য সমভাবে প্রয়োগ করতে হবে—নাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।”
এই ঘটনা আবারও সমাজের সামনে এক বড় প্রশ্ন তুলে ধরেছে—কোনটি সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা, আর কোনটি মানবিকতার পরিপন্থী বৈষম্য?