আমাদের সেই ঘরোয়া সংস্কৃতি বা লোকসংস্কৃতি আজ প্রায় লুপ্ত/

 


আমাদের সেই ঘরোয়া সংস্কৃতি বা লোকসংস্কৃতি আজ প্রায় লুপ্ত/ মোহাম্মদ সাদউদ্দিন

----------------------------------------

আমাদের ঘরোয়া সংস্কৃতি,  লোকজ সংস্কৃতি বা লোকসংস্কৃতিগুলো কি আজ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে?  আর কি দেখতে পাওয়া যায়  গ্রাম্য মেলা-খেলাগুলো? আর কি দেখতে পাওয়া যায়  সেই আমাদের ঘরোয়া সেই কবি গান? আউলবাউল বা ফকিরি গান? সত্যপীরের গান? যাত্রাপালা? বোলান?  অথবা লেটো , আলকাপ বা পঞ্চরস? সেই  আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আব্বাসউদ্দিনের ভাওয়াইয়া বা পল্লীগীতি, আব্দুল আলিমের পল্লীগীতি বা গোষ্ঠ গোপালের দেহতত্ত্বের গান? আজ আর বেশি শোনা যায় না। ভাটিয়ালিরও ভাঁটা।  এগুলোই তো লোকজ সংস্কৃতি । এগুলোই তো লোকসংস্কৃতি বা আমাদের চিরাচরিত ঘরোয়া সংস্কৃতি ।

লেটোর জগত থেকে উঠে আসা বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময়কর প্রতিভা কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি এখন বাংলাদেশের জাতীয় কবি হলেও সঙ্গীত ও  সুরসাধনায় আন্তর্জাতিক। বাংলা-উর্দু-হিন্দি ভাষায় গান রচনা। একজন বিপ্লবী কবি। দিন ও সময় বদলের কবি। সাম্যবাদী কবি। রোমান্টিক কবি। সাহিত্যের সব ধারাতেই তার সচল উপস্হিতি। একজন সব্যসাচী লেখক।অন্যদিকে আলকাপ বা পঞ্চরসের জগৎ থেকে উঠে আসা আরেক কিংদন্তী কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ।   এই আলকাপকে কেন্দ্র করে ঐ জগতের ওস্তাদ ঝাঁকসুকে নিয়ে লেখা তার বিখ্যাত উপন্যাস 'মায়ামৃদঙ্গ'। আলকাপের জগতেও তিনি সিরাজ মাস্টার নামে পরিচিত।  যদিও তিনি একজন উচ্চমানের ক্লাসিক লেখক। তবুও  তিনি বিশ্বনন্দিত তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি 'অলীক মানুষ'-এর জন্য। কিন্তু তিনি একজন বিখ্যাত ঝকঝকে গদ্যকার ।  তার কারিগর থেকে প্রকাশিত  প্রবন্ধ সংকলন 'কথামালা'  পড়লেই তা বোঝা যায়।

জন্মসূত্রে আমি মুর্শিদাবাদের ছেলে। বিশেষ‌ করে কান্দী মহকুমা এলাকার সন্তান বলে এখানকার পীরের মাজারকে কেন্দ্র করে যে সব সব ফকিরি গান, আউল-বাউলের গান, শব্দের গান, মুর্শিদি গান, কবি গান,  পুতুল নাচ, নানান ধরণের খাবার , ছানার মিস্টি, সব যেন গ্রামীণ সংস্কৃতিক তুলে ধরা হয়। অবাক করার মতো মিলন-সেতু তৈরি করতো। আজ কোথায় গেল সেই সব মেলাখেলাগুলো? আবার দেবদেবীকে সামনে রেখে কমলাদেবীর মেলা , পূর্ব বর্ধমানের  কেতুগ্রাম থানার পৌষ মাসের দধিয়া-বৈরাগ্য তলার মেলা তার ঐতিহ্য যেন অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। এইসব মেলাগুলোতে  হাতে তৈরি করা বাঁশ ও বাঁশের কঞ্চির কত দ্রব্যসামগ্রী পাওয়া যেত। কী তার নান্দনিকতা। আজ এই প্রযুক্তির যুগে এগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে।

বীরভূম জেলার পাথরচাপুড়ি দাতাবাবার মাজারের মেলা শুধু ভারত খ্যাত নয়, বিশ্বনন্দিত। কাওয়ালি, ফকিরি , সত্যপীরের গান চারিদিক থেকে শোনা আজো যায়। হিন্দু-মুসলিমের এক বিখ্যাত মিলন সেতু। আর কি সেই জৌলুষ রয়েছে। বিখ্যাত গ্রামীণ শিল্পী আবুল কাসেমের সেই বিখ্যাত গানের লাইন ' চলো সবে যাই দাতা মহবুব শাহ-র দরবার/ঐখানে রেখেছেন আল্লাহ রহমতের ভাণ্ডার'। আজ আর শুনতে পাই না। বর্ধমানের সানোয়ার আলীর  খাজা মৈনুদ্দিন চিশতিকে নিয়ে লেখা , ' এ খাজা গরীব নেওয়াজ সালাম তোমারে/  খাজা সালাম তোমারে ' , আর কি শোনা যায়?  

ভাদ্রমাসের দিনে মনসাপুজোর দিনে গ্রামের তরুণরা 'বেহুলা-লখিনদর'-এর পালা শোনাতে আসতো। গোষ্ট গোপালের সেই গান ' ঘুমায়োনা আর বেহুলা জাইগা দেখরো/কাল রাতে কালনাগিনী দংশাই লখিনদরেরে/ ঘুমায়োনা আর বেহুলা জাইগা দেখরে'।  অথচ মুসলিম গ্রামেই এই পালা হচ্ছে রাস্তায়। মশগুল হয়ে মা-বোনরা শুনছেন। পালাদারদের জন্য বাড়ি বাড়ি চাল তোলা হচ্ছে। অর্থ্যাৎ  গ্রামের লোকজন তাদের লোকজ সংস্কৃতিকে আন্তরিকতার সঙ্গেই নেয়।  

একে একে সব হারিয়ে যাচ্ছে।

রাঢ়বঙ্গে অঘ্রাণ মাসের নতুন ধানের চালে নবান্ন। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে করেন। আর এই উৎসবকে কেন্দ্র করে যাত্রা-পালা ও কবিগান।  গুমানি দেওয়ান, চাঁদ মহম্মদ , দেবেন চাঁইদের সেই কবিগানের পালা হারিয়ে গেছে আজ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url