স্যার' নিয়ে শোরগোলের প্রেক্ষাপটে দু'চার কথা

 'স্যার' নিয়ে শোরগোলের প্রেক্ষাপটে দু'চার কথা  

মজিবুর রহমান, প্রধানশিক্ষক, কাবিলপুর হাইস্কুল, মুর্শিদাবাদ 





     'স্যার' নিয়ে জোরদার শোরগোল শুরু হয়েছে। কেউ এটাকে ভোটার তালিকা সংক্রান্ত একটা সাধারণ বিষয় হিসেবে দেখছেন, কেউ এটার সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পঞ্জির মতো গুরুতর বিষয়ের সংযোগ আছে বলে মনে করছেন। এবছরের জুন মাসে প্রথম দফায় (ফেজ ওয়ান) বিহারে স্যার-এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকে যে বিতর্ক শুরু হয়েছিল তা আরও ঘনীভূত হয়েছে ২৭শে অক্টোবর দ্বিতীয় দফায় পশ্চিমবঙ্গ সহ ১২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য স্যার-এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর। বিতর্কের সঙ্গী হিসেবে, বিশেষ করে আমাদের বঙ্গে, বিরাজ করছে ভয়ভীতি আর আতঙ্ক, ছড়াচ্ছে গুজব ও বিভ্রান্তি। এই আবহে স্যার সম্পর্কে সঠিক তথ্য অনুসন্ধান অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

      দেশের বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে প্রায় প্রতি বছরই ভোটার তালিকা সংশোধন বা রিভিশন করা হয়। পরিমার্জন প্রক্রিয়ায় সাধারণত নতুন ভোটারদের নাম সংযোজন ও মৃত ভোটারদের নাম বিয়োজন করা হয়। এই গতানুগতিক সংশোধন প্রক্রিয়া ছাড়াও ভারতের নির্বাচন কমিশন মাঝেমধ্যেই বৃহৎ আকারে ভোটার তালিকা পরিমার্জনের আয়োজন করে থাকে যাকে বলা হয় 'নিবিড় সংশোধন' বা ইনটেনসিভ রিভিশন (আই আর)। ১৯৫২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অন্তত ৮ বার নিবিড় সংশোধন করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে শেষ বারের মতো হয়েছিল ২০০২ সালে। নির্বাচন কমিশন ২০২৫ সালে 'বিশেষ' বা স্পেশাল শব্দটি যুক্ত করে ভোটার তালিকা সংশোধনের বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। তাই 'আই আর' 'এস আই আর' বা 'স্যার' হয়েছে। গতানুগতিক সংশোধনের সময় যাঁদের প্রয়োজন হয় তাঁরাই দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকের কাছে অথবা অফিসে আবেদন নিয়ে হাজির হন। কিন্তু 'আই আর' অথবা 'এস আই আর'-এর সময় আধিকারিকরাই মানুষের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে যান। এই বিশেষ উদ্যোগের ঘোষিত লক্ষ্য হলো সকল বৈধ ভোটারকে তালিকাভুক্ত করা, তালিকা থেকে সকল মৃত, অবৈধ ভোটারের নাম বাদ দেওয়া এবং কোনো ভোটারের নাম যাতে একাধিক জায়গায় না থাকে তা নিশ্চিত করা, সবমিলিয়ে একটি নির্ভুল ও স্বচ্ছ ভোটার তালিকা প্রকাশ করা। 

       বিহারের সাম্প্রতিক স্যার-এর হিসাবটা ভালো ভাবে বুঝলে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি বুঝতে সুবিধা হবে। বিহারে এসআইআর শুরুর আগে ভোটার সংখ্যা ছিল ৭.৮৯ কোটি। ১লা আগস্ট প্রকাশিত খসড়া তালিকায় নাম ওঠে ৭.২৪ কোটি। অর্থাৎ নাম কাটা যায় ৬৫ লাখ। দাবি ও আপত্তি (ক্লেমস অ্যান্ড অবজেকশনস) জানানোর পর্বে ১৬ লক্ষ নাম সংযুক্ত হয় এবং ৩০শে সেপ্টেম্বর প্রকাশিত চূড়ান্ত তালিকায় ভোটার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭.৪০ কোটি। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত ভোটার সংখ্যা কমেছে ৪৯ লাখ। বর্তমানে বিহারের মোট জনসংখ্যা হল আনুমানিক ১৩ কোটি। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৫৭ শতাংশ ভোটার। এখন পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যা সর্বোচ্চ ১০.৫০ কোটি এবং জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ ভোটার ধরা হলে ভোটার সংখ্যা হতে পারে ৬.৮২ কোটি। কিন্তু ২৭.১০.২০২৫ তারিখ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের ভোটার সংখ্যা হল ৭.৬৫ কোটি। অর্থাৎ ভোটার তালিকায় ৮৩ লাখ অতিরিক্ত নাম রয়েছে। এই অতিরিক্ত নামগুলোর একটি বড় অংশ মারা গেছে, একটি অংশ রাজ্যের অভ্যন্তরে একাধিক জায়গায় নাম রেখেছে, একটি অংশ রাজ্য ছেড়ে ভিন রাজ্যে অথবা বিদেশে চলে গেছে এবং একটি অংশ অস্তিত্ববিহীন। পশ্চিমবঙ্গে ২০০২ সালে শেষ বারের মতো যখন নিবিড় সংশোধন হয়েছিল তখন চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ৪.৫৮ কোটি ভোটার এবং কাটা গিয়েছিল ২৮ লক্ষ নাম। তবে বৈধ ভোটারের নাম বাদ যাওয়ার অভিযোগ ওঠেনি।

       ভারতে ভোটার হওয়ার জন্য একজন ব্যক্তিকে ভারতের নাগরিক, ন্যূনতম ১৮ বছর বয়সী এবং কোনো একটি কেন্দ্রের (কনস্টিটুয়েন্সি) বাসিন্দা হতে হয়। কিন্তু নাগরিকত্বের বিষয়টি একটুখানি গোলমেলে কারণ নাগরিকত্বের পরিচয়বাহী কোনো সুনির্দিষ্ট নথি চিহ্নিত অথবা চালু করা হয়নি। এজন্য কোটি কোটি ভারতীয়কে মাঝেমধ্যেই নাগরিকত্ব প্রমাণের পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। নানান ধরনের নথি দেখাতে হয়। স্যার-এর জন্য নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত ১২টি নথি হল: (১) কেন্দ্রীয় অথবা রাজ্য সরকারের কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন অথবা পেনশন পান এমন পরিচয়পত্র, (২) ১৯৮৭ সালের ১লা জুলাইয়ের আগে ব্যাঙ্ক, ডাকঘর, ভারতীয় জীবন বীমা নিগম প্রভৃতি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা প্রদান করেছে এমন নথি, (৩)  জন্মের শংসাপত্র, (৪) পাসপোর্ট, (৫) মাধ্যমিক বা তদূর্ধ্ব শিক্ষাগত যোগ্যতার শংসাপত্র, (৬) রাজ্যের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত স্থায়ী বাসস্থানের শংসাপত্র, (৭) বনভূমি অধিকার শংসাপত্র, (৮) এসসি, এসটি, ওবিসি প্রভৃতি জাতিগত শংসাপত্র, (৯) জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এন আর সি), (১০) রাজ্য বা স্থানীয় প্রশাসনের দ্বারা তৈরী করা পরিবার পঞ্জী (ফ্যামিলি রেজিস্টার), (১১) জমি বা বাড়ির দলিল এবং (১২) আধার কার্ড। এগুলোর মধ্যে যেকোনো একটি ডকুমেন্ট দেখাতে হবে। দুই-এক শতাংশ নিরক্ষর, হতদরিদ্র, ভবঘুরে, ঠিকানাবিহীন মানুষ ছাড়া বাকি সকলেরই এগুলোর মধ্যে অন্তত একটি নথি রয়েছে বলেই মনে হয়। উল্লেখ্য, প্রথমে নথির সংখ্যা ছিল ১১টি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আধার কার্ডকে ১২তম নথি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কাজে বহুল ব্যবহৃত ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড ও রেশন কার্ড আশ্চর্যজনকভাবে ব্রাত্যই রয়ে গেছে। আধার কার্ডের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, এটা পরিচয়পত্র হিসেবে ব্যবহার করা গেলেও নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে এর কোনো মান্যতা থাকবে না। এখানে আধার কার্ডের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে নাগরিকত্বের প্রশ্নটি টেনে এনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে বলে মনে হয়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ অবশ্য আধার কার্ডকে নথি হিসেবে দেখিয়েই স্যার-এ নাম তুলবেন।

       ২০২৫ সালের ভোটার তালিকায় নাম আছে এমন সকলের জন্যই এনুমারেশন (গণনা ) ফর্ম তৈরি হয়েছে। এসআইআর-এ নাম তুলতে আগ্রহী সকলকেই সেই ফর্ম পূরণ করতে হবে। ৪ঠা নভেম্বর থেকে ৪ঠা ডিসেম্বর পর্যন্ত গণনা পর্বে (এনুমারেশন ফেজ) বুথ লেভেল অফিসার বা বিএলও সেই ফর্ম নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরবেন। বিএলও-রা হবেন স্থানীয় সরকারি কর্মী। তাঁদের কাজে সহযোগিতা করতে থাকবেন স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের বুথ লেভেল এজেন্ট বা বিএলএ। এই পর্বে কোনো নথি জমা দিতে হবে না। শুধু নতুন ভোটার কার্ডের জন্য পাসপোর্ট সাইজের ফটো লাগবে। অনলাইনেও এনুমারেশন ফর্ম পূরণ করা যাবে। অফলাইনেও নির্দিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে তাঁর পরিবারের সদস্যরা ফর্ম পূরণ ও স্বাক্ষর করতে পারবেন। এজন্য ভিন রাজ্য অথবা বিদেশ থেকে তাড়াহুড়ো করে কারোর বাড়ি আসার দরকার হবে না। 

        ২০০২ ও ২০২৫ সালের দুটি ভোটার তালিকাতেই যাঁদের নাম আছে অর্থাৎ যাঁরা 'ম্যাপিং'-এর আওতায় এসেছেন তাঁরা পুরোপুরি 'সেফ জোন'-এ থাকবেন, তাঁদের কোনো ডকুমেন্ট লাগবে না। শুধু নতুন ভোটার কার্ডের জন্য পাসপোর্ট সাইজের ফটো লাগবে। ভারতে জন্মগ্ৰহণ করেছেন এবং ২০২৫ সালের তালিকায় নাম আছে কিন্তু ২০০২ সালের তালিকায় নাম নেই এমন ব্যক্তিরা ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় থাকা বাবা, মা অথবা অন্য কোনো আত্মীয়ের নাম দেখিয়ে স্যার-এ নাম তুলে নিতে পারবেন। ভারতের বাইরে যাঁদের জন্ম তাঁদের ভারতীয় মিশন কর্তৃক প্রদত্ত বার্থ সার্টিফিকেট দেখাতে হবে। যাঁরা ভারতের বাইরে থেকে এসেছেন তাঁদের নাগরিকত্ব নিবন্ধনকরণ শংসাপত্র দেখাতে হবে। শেষোক্ত শর্তটি উদ্বাস্তু, অনুপ্রবেশকারী ও শরণার্থীদের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে।এটাতে নদিয়া জেলার মতুয়া সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ সমস্যায় পড়তে পারেন। ২০২৫ সালের ভোটার তালিকায় যাঁদের নাম নেই তাঁদের জন্য এনুমারেশন ফর্ম তৈরি হয়নি। এমন ব্যক্তিদের ১.১.২০২৬ তারিখের ভিত্তিতে ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য বিএলও ৬ নম্বর ফর্ম সরবরাহ করবেন এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্র সহ সেই ফর্ম পূরণ করতে হবে।

      এক মাস ধরে ইনুমারেশন ফর্ম ও নতুন ভোটার ফর্ম পূরণ পর্ব শেষ হবার পর ৯ই ডিসেম্বর'২৫ খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। ২০০২ সালের ভোটার তালিকার সঙ্গে যাঁদের সংযোগ (লিঙ্ক) নির্ধারণ করা যাবে না তাঁদের নাম খসড়া তালিকায় থাকবে না এবং তাঁদেরকে ৯ই ডিসেম্বর'২৫ থেকে ৮ই জানুয়ারি'২৬ পর্যন্ত এক মাস ধরে নোটিশ পাঠিয়ে নথি দেখাতে বলা হবে। আবার ৯ই ডিসেম্বর'২৫ থেকে ৩১শে জানুয়ারি'২৬ পর্যন্ত ভোটার তালিকায় নাম তোলার দাবি ও অভিযোগ জানানোর জন্য ৫০ দিনের বেশি সময় রাখা হয়েছে। অবশেষে ৭ই ফেব্রুয়ারি'২৬ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে।বিহারের স্যার-এর অভিজ্ঞতা থেকে অনুমান করা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গেও বিরাট সংখ্যক নাম খসড়া তালিকার বাইরে থাকবে। কিন্তু তাদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চূড়ান্ত তালিকায় ঠাঁই পাবে।

      কোনো ব্যক্তি এসআইআর প্রক্রিয়ায় অংশ না নিলে ২০২৬ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি প্রকাশিতব্য ভোটার তালিকায় তার নাম থাকবে না। এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার পরেও ভুলবশত কিছু মানুষের নাম ভোটার তালিকায় নাও উঠতে পারে। ভোটার তালিকায় নাম না থাকার কারণে তাঁরা ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দিতে অথবা প্রার্থী হতে পারবেন না। আপাতত এছাড়া অন্য কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ভোটার লিস্টে নাম না থাকা ব্যক্তিদের সকল নাগরিক অধিকার ও সুযোগ সুবিধা আগের মতোই অব্যাহত থাকবে। আগামী বছরগুলোতে যখন ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ হবে তখন তাঁরা আবার নাম তোলার সুযোগ পাবেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url