মহিয়সী বেগম রোকেয়া নারী শিক্ষা, নারী বিপ্লব ও নারী জাগরণের অগ্রদূত
মোহাম্মদ সাদউদ্দিন:
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মুসলিম মহিলাদের বা নারী সমাজের যেমন অবদান রয়েছে, তেমনি অবদান রয়েছে নারীর শিক্ষার প্রসার , তাদের মানসিক বিকাশ ও জাগরণের ক্ষেত্রেও। সেই কৃতিত্ব ইতিহাসের পাতায় সেভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি। এটাই আমাদের কাছে দূর্ভাগ্যজনক। অবিভক্ত ভারত বা ব্রিটিশ ভারতে নারীদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন সাওলাতুন্নিসা (১৮৩২-১৯১০) , নবাব ফৈয়জুন্নেসা চৌধুরী(১৮৩৪-১৯০৩) ও খুজিস্তা আখতার বানু সোহরাওয়ার্দীয়া(১৮৭৩-১৯১৯)। বেগম রোকেয়া ছিলেন তাদের যথার্থই উত্তরসূরী। এদের পথ ধরে তিনি নারী শিক্ষা নারী বিপ্লব ও জাগরণের ক্ষেত্রে এক মহাবিপ্লব ঘটিয়েছিলেন।
সাওলাতুন্নিসা ছিলেন অবিভক্ত বঙ্গের অবিভক্ত ২৪ পরগণার (বর্তমানে উত্তর ২৪ পরগণা) দেগঙ্গা থানার ভাসিলিয়া গ্রামের বিখ্যাত জমিদার মুন্সী এজবাতুল্লাহর কন্যা । বিয়ে হয়েছিল কলকাতার বেলেঘাটায়। তার স্বামী মুন্সী লতাফৎ হোসেনের নামে একটি রাস্তা রয়েছে। তিনিই কলকাতায় প্রথম ছাত্রী নিবাস, অনাথ আশ্রম ও এতিম খানা গড়েন। তার দানের টাকায় আরবে গড়ে ওঠে মাদ্রাসা সাওলাতিয়া বাংলা যা বর্তমানে রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটা কলেজ। তার ভাসিলিয়া গ্রামে তার দান করা ৭বিঘা জায়গাতে ভাসিলিয়া সাওলাতিয়া হাইস্কুল তার স্মৃতিকে বহন করে । ভাষাতত্ত্ববিদ ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নানির(দিদিমা) বোন এই সাওলাতুন্নিসা। নবাব ফৈয়জুন্নিসা ছিলেন কুমিল্লার ভূমিকন্যা। উনবিংশ শতাব্দীতে নারী শিক্ষার প্রসারে তিনি যে মহাবিপ্লব ঘটিয়েছেন তা ছিল অভিনব। ব্রিটিশ সরকার সেদিন তাকে "নবাব" উপাধি দিতে বাধ্য হন। আর খুজিস্তা আখতার বানু ছিলেন অবিভক্ত বঙ্গের শেষ প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৬-৫৭) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মা। অবিভক্ত ভারতের প্রথম সিনিয়র কেমব্রিজ ডিগ্রিধারী মহিলা । স্বামী ছিলেন বিখ্যাত ব্যারিস্টার বিচারপতি জাহিদুর রহমান সোহরাওয়ার্দী । পিতা উবাইদুল্লাহ আল উবাইদি ছিলেন আরেক "বিদ্যাসাগর" ও নবজাগরণের অগ্রদূত। খুজিস্তা আখতার বানুর ভাই হোসেন সোহরাওয়ার্দী ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম উপাচার্য । কলকাতার পার্কসার্কাস এলাকার কড়েয়া বালিকা বিদ্যালয় দিয়ে নারী শিক্ষার অগ্রগতি ঘটিয়েছিলেন তিনি।
হ্যাঁ, এদেরই যথার্থ উত্তরসূরী বেগম রোকেয়া। আবার বেগম রোকেয়ায়া ভাগলপুরে(বিহার)সূচনা পর্বের ছাত্রী সৈয়দা হাসিনা মুর্শেদ ছিলেন অবিভক্ত বঙ্গের আইনসভার বিধায়ক ও স্পিকার(অধ্যক্ষ) । বঙ্গীয় আইনসভার প্রথম মহিলা স্পিকার । তিনি আইনসভায় নারী-শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। পরবর্তীতে কলকাতার বিখ্যাত লেডি ব্রাবোর্ণ কলেজ তার উদ্যোগেই স্হাপিত হয়। সৈয়দা হাসিনা মুর্শেদ ছিলেন অবিভক্ত বঙ্গের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের ভাগ্না বৌ। তার স্বামী সৈয়দ মঞ্জুর মুর্শেদ ও দেওর সৈয়দ মাহবুব মুর্শেদ ছিলেন ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত বঙ্গের প্রথম মুসলিম আই সি এস। দেশ ভাগ হলে পাকিস্তান আমলেই সৈয়দ মাহবুব মুর্শেদ বিচারপতি হলে রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব খানের মার্শাল ল'-এর বিরুদ্ধে জাজমেন্ট দেন। এই ইতিহাস আজ বিলুপ্ত। কলকাতা ছিল একরকম বেগম রোকেয়ায়ার কর্মস্হল। অল্প বিস্তর আলোচনা বা চর্চা এখানেও হয়। বিশ্বকোষ পরিষদের কর্ণধার প্রয়াত পার্থ সেনগুপ্ত , বিদ্যাসাগর ফাউণ্ডেশনের প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় বা অধ্যাপিকা মীরাতুন্নাহার , ড: সালেহা বেগম রোকেয়াকে নিয়ে কাজ করছেন। উদ্ধার করা হয়েছে কলকাতার নিকটেই পানিহাটি পুরসভার সোদপুরে গঙ্গার ধারে চিরনিদ্রায় শায়িত বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেনের কবরটি। বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে কবরখানি। কলকাতার এন্টালিতে ১৬২ বি এ জি সি বোস রোডে তিনি কিছুদিন বসবাস করেন। এখন সেখানে ভূপেশভবনের সামনে বিশ্বকোষ পরিষদের উদ্যোগে গড়ে উঠে রোকেয়া মিনার। প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর বিশ্বকোষ পরিষদ এখানে তার জন্মদিন পালন করে। কলকাতার পার্কসার্কাস এলাকায় বামজামানায় গড়ে উঠেছিল রোকেয়া পার্ক। আজো তা অম্লান। এছাড়াও কলকাতার লর্ড সিনহা রোডে শাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব ও বিদ্যাসাগর ফাউণ্ডেশনের কর্ণধার প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়মিত বেগম রোকেয়াকে নিয়ে চর্চা করেন। তিনি একজন জ্বলন্ত অভিধান।
অবিভক্ত বঙ্গের রংপুর জেলার বিখ্যাত পায়রাবন্দ গ্রামের ভূমিকন্যা বেগম রোকেয়া। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম জহিরুদ্দিন মহম্মদ আবু আলী হায়দার চৌধুরী, মায়ের নাম রাহাতুন্নেসা চৌধুরী। রোকেয়ার দুই ভাই যথাক্রমে ইব্রাহিম সাবের ও খলিল সাবের। বড় বোন করিমুন্নেসা। নানান প্রতিকুল পরিস্হিতিকে অতিক্রম করে তিনি নারী শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছিলেন। ঘটিয়েছিলেন নারী বিপ্লব ও নারী জাগরণ।
১৮৯৬ সালে রোকেয়ার বিয়ে হয় ভাগলপুরবাসী খানবাহাদুর সৈয়দ শাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। শাখাওয়াত হোসেন (১৮৫১-১৯০৯)ছিলেন তখনকার দিনের গ্রাজ্যুয়েট । আবার এস আর এ সি পাশ। তিনি ছিলেন উড়িষ্যার কণিকা স্টেটের ম্যানেজার। এই স্বামী শাখাওয়াত হোসেনই রোকেয়ার যাবতীয় অনুপ্রেরণার উৎস। যদিও রোকেয়ার বড় বোন করিমুন্নেসা তার আরেক উৎসাহ। বিয়ের ১২ বছরের মাথায় ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন স্বামী খানবাহাদুর সৈয়দ শাখাওয়াত হোসেন। স্বামীর দেওয়া ১০ হাজার টাকা নিয়ে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ শাহ আব্দুল মালেকের সরকারি বাসভবনের গোলকুঠিতে স্কুল গড়ে তোলেন ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর । এই মালেক সাহেবের চার মেয়ে সৈয়দা কানিজ ফাতেমা, সৈয়দা আনতুজা জোহরা , সৈয়দা হাসিনা খাতুন(মুর্শেদ) সৈয়দা আহসানা খাতুন ও আরো একজন ছাত্রী মিলে মোট ৫ ছাত্রীকে নিয়ে মহিলা শিক্ষার প্রসারে স্কুলের সূচনা করেন। পরবর্তীতে কোনো কারণবশত রোকেয়া ১৯১১ সালে কলকাতা চলে এলেন। কলকাতায় রোকেয়া আশ্রয় নিয়েছিলেন মালেক সাহেবের ছোটভাই সৈয়দ আব্দুল সালেকের বাড়িতে। তারপর রোকেয়া তার বড়ভাই ইব্রাহিম সাবেরের বাড়িতে থাকতে লাগলেন। এই মালেক সাহেব ছিলেন ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট । তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদের ভরতপুর থানার শাহপুর গ্রামের ভূমিকন্যা। মধ্যকলকাতার তালতলার কাছে ১৩ নম্বর শাহ ওলিয়ুল্লাহ লেনে শাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের ভিত্তি স্হাপন করলেন। স্বামীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্কুলের নাম রাখা হল শাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল। সূচনা করা হল ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ। স্কুলটির নাম হল শাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। এটিই কলকাতার বুকে প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। ১৯২৭ সালে ব্রিটিশ আমলেই স্কুলটি সরকারি অনুমোদন পায়।পরবর্তীতে নানান পরিস্হিতির সম্মুখীন হয়ে ইউরোপীয় এসাইলেম লেন(আব্দুল হালিম লেন) হয়ে এই স্কুল শেষ পর্যন্ত স্হানান্তর হয়ে স্হায়ীভাবে এখন কলকাতার লর্ড সিনহা রোডে। বেগম রোকেয়া একজন ভালো সাহিত্যিক ও লেখিকা ছিলেন। মতিচূর বা সুলতানার স্বপ্ন জ্বলন্ত উদাহরণ। তার প্রতিষ্ঠিত তারিণীভবন,আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতীন-ই -ইসলাম, কলকাতা মহামেডান লেডিজ এ্যাসোসিয়েশন হল তার বড় উদাহরণ।
বেগম রোকেয়া আজ নেই। কিন্তু তার কর্মকাণ্ড আজ ইতিহাস। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। আজো দু:খের বিষয় , কলকাতায় তার নামে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ নেই। অথচ কলকাতাই ছিল তার কর্মভূমি। আর কলকাতার কাছেই তিনি চির নিদ্রায় শায়িত। তবে কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিমরা মিশনকেন্দ্রিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে সেগুলির কারুর নাম রোকেয়া মিশন অথবা রোকেয়া একাডেমি। এইভাবেই রোকেয়া আমাদের কাছে চিরজাগ্রত। বাংলাদেশে রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সহ সেদেশের ৬৪টি জেলায় তার নামে নানা ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আমরা চাই, কলকাতাতে তার নামে কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় হোক। বেগম রোকেয়া মানে এক বিপ্লব। বেগম রোকেয়া মানে নারী-অনুপ্রেরণা। নারী-উৎসাহ। নারী-জাগরণ।
বেগম রোকেয়ার উত্তরসূরী হলেন সৈয়দা হাসিনা মুর্শেদ, বেগম সুফিয়া কামাল , জাহানারা ঈমাম প্রমুখরা।
(লেখক কলকাতার বিশিষ্ট চিন্তাবিদ,সাংবাদিক,সাহিত্যিক ও গবেষক)