খিলজী নয়, ব্রাহ্মণ্যবাদীরাই ধ্বংস করেছে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়
ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু
বর্তমানে ভারতবর্ষ হিংসা-বিদ্বেষে ভর্তি হয়ে রয়েছে। এ ভেদ-বৈষম্যের কারণে সমাজে শক্তিহীন বর্গ বিশেষ করে গলিত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অনেক হিংসাত্মক ঘটনা হয়ে যাচ্ছে। এ সমস্ত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে এবং এ মিথ্যা প্রসারের সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হল ঐতিহাসিক ঘটনা সমূহের বিকৃত করে প্রস্তুত করা। এ সময়ে ভারতবর্ষের প্রাচীন, মধ্য এবং আধুনিক-এ তিন কাল সম্পর্কে বিকৃতি করণ শুরু হয়েছে। যে সকল ঐতিহাসিক ভারতের ইতিহাসকে যৌক্তিক বিবেচনা করতে চান, ভারতে বহুত্ববাদী চরিত্রকে সামনে আনতে চান, তাঁদের উপর দীর্ঘদিন হতে চলে আসা ব্রাহ্মণ্য বিচারধারার রাজনৈতিক লোকদের কটু ও তীব্র হামলা শুরু হয়েছে এবং তাঁদের বদনাম করার জন্য যথাসম্ভব প্রচেষ্টা চলছে।
ভারতের অতীতকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ও সম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদীরা একেবারে পৃথক-পৃথকভাবে দেখে থাকেন। ইতিহাসকে বুঝা এবং বিবেচনা উভয়ের মধ্যে কেবল পৃথকই নয়, তা পরস্পরের বিরোধাভাষীও দেখা যায়। কোন কোন ঐতিহাসিক সম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে ইতিহাসকে বিকৃত করতে নিজেদের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেছেন। তাঁরা এ বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখার প্রয়োজনই মনে করেননি, কোনদিন প্রকৃত গবেষকেরা ইহার সত্যতা প্রকাশ করবেন।
দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের পূর্ব অধ্যাপক আন্তর্জাতিক খ্যাতি প্রাপ্ত ড. দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা (১৯৪০-২০২১) ছিলেন এরকম এক অধ্যাপক, যাঁকে অনেকবার প্রাণে মারার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। বিগত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০২১ অধ্যাপক ঝা মহোদয়ের মৃত্যু কেবল ভারত বর্ষের জন্য ক্ষতি নয়, বরং বিশ্বের সমগ্র ঐতিহাসিকদের জন্যই এক বড় ক্ষতি হয়েছে। যিনি ভারতে বহুত্ববাদী ও ভ্রাতৃতের চরিত্রকে প্রতিষ্ঠিত ও প্রসারিত করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন এবং সে লক্ষ্যে কাজ করেছিলেন। অধ্যাপক ঝা ছিলেন সে সাম্যতা আন্দোলনের একজন অকুতোভয় চরিত্র। তিনি নিজের গভীর অধ্যয়ন দ্বারা ভারতবর্ষের প্রাচীন এবং মধ্যকালীন ইতিহাসকে যথার্থভাবে বুঝতে অন্যদের সহায়তা করেছেন। ব্রাহ্মণ হলেও তিনি ছিলেন উদার চরিত্রের লোক।
তাঁর লিখিত ‘Myth of Holy Cow’ এ পুস্তকটি প্রকাশ হওয়ার পর তাঁকে প্রাণে মারার জন্য বিভিন্ন হুমকি-ধমকি নানা দিক হতে আসছিল। হলি কাউ বা পবিত্র গাভীর আখ্যানের একমাত্র উপজীব্য বিষয় ছিল দলিত এবং মুসলমানদের আতঙ্কিত করতে যা কিছু করা হয়েছে, সেগুলির তিনি মুখোন্মোচন করেছেন। আমরা এ আখ্যানের দ্বারা দেখেছি যে, কিভাবে দলিতবর্গ এবং মুসলিমদেরকে স্থানে স্থানে অত্যাচারিত করা হয়েছে। ভারতের উত্তর প্রদেশের উন্নার ঘটনা আমরা ভুলতে পারি কি? যেখানে মৃত গরুর চামড়া তুলতে গিয়ে চার দলিত যুবককে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।
অধ্যাপক ঝা মহোদয়ের এ পুস্তক, যা ছিল হিন্দু ধর্মগ্রন্থ সমূহের উপর গভীর অধ্যয়নের ফসল, তাতে বলা হয়েছিল যে, প্রাচীন ভারতে গোমাংস ভক্ষণ ছিল সাধারণ মানুষের খাদ্যাভ্যাসের অংশ। বৈদিক এবং বৈদিকোত্তর উভয়কালে ভারতে গোমাংস খাওয়া হত। অধ্যাপক ঝা স্বীয় পুস্তকে হিন্দু মূলগ্রন্হ সমূহের উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন এবং গোমাংস ভোজন হওয়ার সম্বন্ধে অকাট্য যুক্তি খাঁড়া করেছিলেন। অধ্যাপক ঝা নিজের গবেষণায় যা প্রমাণিত করেছেন, তা বাবা সাহেব ড. ভীমরাও আম্বেদকর (১৮৯১-১৯৫৬) অথবা অন্যান্য অনেক বিদ্বানেরাও পূর্ব হতে বলে আসছিলেন। বাবা সাহেব ড. আম্বেদকর স্বীয় পুস্তক ‘ Who were the Shudras?’ এ তাহাই লিখেছেন।স্বামী বিবেকানন্দেরও ( ১৮৬৩-১৯০২) ছিল একই মান্যতা।
তিনি বলেছেন যে-‘তোমরা আশ্চর্য হবে যে, পুরাতন সময়ে ইহা মান্য করা হত যে, গোমাংস না খেলে সে ভাল হিন্দু নয়। এক ভাল হিন্দুর জন্য কোন পর্বে ষাঁড়কে বলি দিয়ে তার মাংস খাওয়া অনিবার্য ছিল।’ স্বামী বিবেকানন্দ এ কথা ১৯০০ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি আমেরিকার কালিফোর্নিয়ার পসাডেনা স্থিত শেক্সপিয়র ক্লাবে ‘Buddhist India’ বিষয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন। ইহার বিবরণ ‘The complete works of Swami Vivekananda, Vol. 3, (Kolkata Advaita Ashram, 1997, Page-536 এ লিপিবদ্ধ রয়েছে।
অধ্যাপক ঝা মহোদয়ের গবেষণা পূর্ণ পুস্তকটি একটি মস্তবড় শক্তি যোগায়, যাঁরা ভারতবর্ষে খাদ্যাভ্যাসের বিবিধতাকে মর্যাদা দান করতে চান।
সাম্প্রদায়িক লোকদের মধ্যে সত্যিকারভাবে গো-মাতার উপর কোন প্রেম নাই। ইহা এ বিষয়ের দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, সম্প্রতি রাজস্থানের হিঙ্গোরিয়া গো-শালায় শতাধিক গাভী ক্ষুধা ও রোগে মারা যাওয়ার ঘটনাতে। এতে গো-ভক্তদের কোন রকমের হেল-দোলই নাই। তাঁরা ইহা আমলই নিতে চাননি। বিজয় ত্রিবেদী স্বীয় পুস্তক ‘হার নহি মানুঙ্গী’ অর্থাৎ হার মানবনা শীর্ষক লেখাটি ছিল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর জীবনী। সে পুস্তকে তিনি লিখেছেন যে-‘ বাজপেয়ীজী আমেরিকায় গরুর মাংস খাওয়ার সময় ঠাট্টা করে বলছিলেন যে, তিনি কোন ভুল করছেননা, কারণ এ গো-মাংস হল আমেরিকান গাভীর।’
সাম্প্রতিক কালেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী অযোধ্যায় রাম মন্দির কার্যের উদ্বোধন করেছেন। এরপর হতে রাম মন্দির নির্মাণের জন্য জায়গা জায়গা হতে দান সংগ্রহের কাজ জোরেসোরে শুরু হয়েছে। চাঁদা সংগ্রহকারীরা পরিস্কার বলে দিয়েছেন যে, ‘না’ শুনার অভ্যাস তাঁদের নাই। ঐতিহাসিকেরা রাম মন্দির সম্পর্কিত এক রিপোর্ট তৈরী করেছিলেন। এ রিপোর্টের শীর্ষক ছিল-‘ Ram Janmabhumi Babri Masque: A Historians Report to the Nation.’ ঐতিহাসিকদের কমিটি যাঁরা এ রিপোর্ট তৈরী করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক ঝাও একজন ছিলেন। এ রিপোর্টে স্পষ্ট শব্দে বলা হয়েছে যে, কোন মন্দিরকে ধ্বংস করে যে বাবরী মসজিদ তৈরী হয়েছে, ইহার যেমন কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নাই, তেমনি যেখানে ভগবান রামের জন্ম হয়েছে দাবী করা হচ্ছে, সেখানেও যে রাম মন্দির ছিল, তারও কোন প্রমাণ নাই। সুপ্রিম কোর্ট ঐতিহাসিক রায় উল্লেখ করে রিপার্টটি বাতিল করে দিয়েছে। কিন্তু, সুপ্রিম কোর্ট যে সারাংশে পৌঁছেছিল,তা এ রিপোর্টের সারাংশের সাথে মিল ছিল। সে কথা হল অন্য। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তাঁদেরকেও মসজিদের জন্য জমিনের অংশ দিয়েছে, যাঁদেরকে মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ করার জন্য দোষী করা হয়েছিল।
এখন বিহার স্থিত প্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করার জন্য বক্তিয়ার খিলজীর উপর দোষ দেওয়া হচ্ছে। খিলজী দেশের অন্যান্য স্থানের বিভিন্ন উৎপাত করলেও তিনি যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেছেন, তার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ এখনও পাওয়া যায় নাই। বরং নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা, তার প্রমাণ রয়েছে। বৌদ্ধধর্মের বাড়-বাড়ন্ত প্রভাবকে তাঁরা সহ্য করতে পারেননি। বিভিন্ন গবেষণা স্রোতের উদ্ধৃতি দিয়ে অধ্যাপক ঝা লিখেছেন যে-‘ বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মধ্যে অনেক সময়েই হাতাহাতি হয়েছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাতে এতই নারাজ হয়েছিল যে, তাঁরা ১২ বছর পর্যন্ত ভগবান সূর্যের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করেছিলেন এবং অত:পর জ্বলন্ত কুণ্ডের অঙ্গার নিয়ে তাঁরা বৌদ্ধ মন্দির ও বিহার সমূহে নিক্ষেপ করেছিলেন।
যে সমস্ত বৌদ্ধ ইহামরত সমূহের উপর হামলা হয়েছিল, সেগুলির মধ্যে যুক্ত ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ও। সেখানকার অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বিশাল পুস্তকালয়, যাকে রত্নবোধি বলা হত, তাকেও জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিয়েছিল।’ এ প্রাচীন অধ্যয়ন কেন্দ্রের নষ্ট করার জন্য খিলজীর উপর দোষারোপনের উদ্দেশ্য ছিল, বৌদ্ধধর্ম এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের মধ্যে শুরু হতে যে সংঘর্ষ চলে আসছিল, যা ছিল প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের ধারা, সত্যিকারভাবে সেদিক হতে লোকের দৃষ্টি ফিরানো।
মঙ্গলোরের পূর্ব আর. এস. এসের প্রচারক কর্মকর্তা প্রমোদ মুতাল্লিকের নেতৃত্বে শ্রীরাম সেনে দ্বারা এক পব সংগীতানুষ্ঠান চলছিল, যেখানে মেয়েরা মদ্যপান করছিল। সেখানে হামলার ঘটনার পর অধ্যাপক ঝা একটি পুস্তক লিখেছিলেন, সে পুস্তকের নাম ছিল-‘ Drink of Immortality।’ এ পুস্তকে অধ্যাপক ঝা বলেছেন যে, প্রাচীন ভারতে কিভাবে বিভিন্ন প্রকারের শরাব বা মদ্য তৈরী হত এবং নারী-পুরুষ সবাই সেগুলি ভরপুর পান করে আনন্দ নিতেন। তার প্রমাণ ইহাও সিদ্ধ করেছে যে, বেদ, রামায়ন এবং মহাভারতে মদ্যপানের সংস্কৃতি ছিল।
অধ্যাপক ঝা ছিলেন সে সকল বিদ্বানদের মধ্যে একজন, যিনি সক্রিয়রূপে এরকম এক উন্নত সমাজ গঠনের সংঘর্ষে স্বীয় জীবন সমর্পণ করেছিলেন, যা বিবিধতা ও বহুত্ববাদের বিশ্বাসকে সম্মান করে। তিনি এরকম সমাজের কথা চিন্তা করতেন, যা শোষিত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার সমূহকে সুরক্ষিত করে। তিনি এরকম সমাজের কল্পনা করতেন, যেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে নীচ ও তুচ্ছ দৃষ্টিতে দেখবেনা। দেশের বিভিন্ন বর্ণ, বিভিন্ন ধর্ম এবং বিভিন্ন সংস্কৃতিকে সুরক্ষিত করতে সহায়তা করবে। সে কর্তব্য পালনে যেন কেহ ভুলে না যায়।
বর্তমান ভারতের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ হলেন অধ্যাপক ড. রাম পুনিয়ানী। তিনি মুম্বইয়ের আই.আই.টির অধ্যাপক ছিলেন। তিনি অনেক আন্তর্জাতিক সম্মানে বিভূষিত হয়েছেন। তিনিও তাঁর বক্তব্যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদেরকেই দায়ী করেছেন।