সেলিব্রিটি ডাক্তারের মিথ্যে গল্পে ইসলামোফোবিয়া
সেলিব্রিটি ডাক্তারের মিথ্যে গল্পে ইসলামোফোবিয়া
সুমন ভট্টাচার্য
বিমানবন্দরে সিকিউরিটি চেকের সময় নাকি সিআইএসএফের মুসলিম জওয়ান নিজেই যাত্রীর দামী এপলের ঘড়ি চুরি করে নিচ্ছে! আর সেই কাজে তাকে সহায়তা করছে বিমানবন্দরে লাক্সারি ব্র্যান্ডের দোকানের এক মুসলিম কর্মী! এহেন অভিযোগ ঘিরে স্বভাবতই তুলকালাম দেশজুড়ে| আলোড়ন| মিডিয়ায় হেডলাইনের পর হেডলাইন। কারণ যদি খাস রাজধানী দিল্লির বিমানবন্দরেই এই ধরনের ঘটনা ঘটে, তাহলে তো অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে দেশের নিরাপত্তা বন্দোবস্ত নিয়ে| যে যাত্রী এই অভিযোগ করলেন, তিনিও যে সে ব্যক্তি নন, দেশের অন্যতম বিখ্যাত ডাক্তার! যিনি আবার একাধিক জয়েন্ট এন্ট্রান্স ট্রেনিং সেন্টারে নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের পাঠ শেখান! এহেন সেলিব্রিটি ডাক্তারের অভিযোগের তীর বিমানবন্দরে কর্মরত এক মুসলিম সিআইএসএফ এর জওয়ানের দিকে! স্বভাবতই তোলপাড়, এবং যথারীতি গোদি মিডিয়ায় খাপ পঞ্চায়েত বসে গেল। কিন্তু সুখের বিষয়, দিল্লি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সিআইএসএফ সিসিটিভির ক্যামেরা ফুটেজ পরীক্ষা করে জানিয়ে দিল ওই চিকিৎসক, সেলিব্রেটি ডাক্তার সম্পূর্ণ মিথ্যে বলছেন! বিমানবন্দরে সিকিউরিটি চেক পেরিয়ে যাওয়ার সময়ের পরেও তাঁর হাতে এপল ওয়াচ দেখা গিয়েছে| এবং তিনি যে ঘটনাক্রমের বর্ণনা দিয়েছেন তার কোনও প্রমাণ সিসিটিভি ফুটেজে নেই। সিআইএসএফ কর্তৃপক্ষ এবং বিমানবন্দর তরফে এহেন পাল্টা জবাব দেওয়ার পরেই ওই সেলিব্রিটি ডাক্তার শুধু যে সোশ্যাল মিডিয়ার তাঁর নিজের ভাইরাল হওয়া পোস্ট মুছে দিলেন তাই নয, নিজেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ডিএক্টিভেটও করে দিলেন। কি বলবো আমরা এই ঘটনাকে? ভারতবর্ষে ইসলামোফোবিয়া বা মুসলিম বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলার নতুন ধরনের কৌশল? না সেলিব্রিটি ডাক্তারের স্বপ্ন বিলাস? যাই হোক, তা যে ভারতবর্ষের সামাজিক কাঠামো, তাকে আঘাত করছে। এই মিথ্যা অভিযোগ যে সম্প্রীতি নষ্ট করার প্রয়াস, সেই সত্যকে তো ধামাচাপা দেওয়া যাবে না|
দিল্লির কাছাকাছি গুরুগ্রামের বাসিন্দা ডক্টর তুষার মেহতার এ হেন অদ্ভুত মিথ্যে অভিযোগ এবং মুসলিম বিদ্বেষকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা নিয়ে আপাতত দেশ জুড়ে আলোড়ন| কেন এই ঘটনাকে মুসলিম বিদ্বেষ তৈরীর চেষ্টাই বলব? তার কারণ গুরুগ্রামের ওই সেলিব্রিটি ডাক্তার শুধু যে একজন সিআইএসএফের সংখ্যালঘু কর্মীকে নিশানা করেছিলেন তাই নয়, তাঁর অভিযোগ ছিল নিরাপত্তা বিভাগের ওই কর্মীকে সহায়তা করেছিলেন বিমানবন্দরে লাক্সারি ব্র্যান্ডের দোকানে কর্মরত আরেক মুসলিম| ডক্টর তুষার মেহতা, যিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন এবং গোটা দেশের চিকিৎসক মহলে যাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল, তাঁর এহেন কাজকর্মকে কি দিয়ে বিশ্লেষণ করব? পশ্চিমবঙ্গে যেসব সংখ্যালঘু একটিভিস্ট বা সমাজকর্মী, যেমন মানজারুল ইসলাম বা আব্দুল মতিন ওয়াসিম সোশ্যাল মিডিয়ায় এই গোটা ঘটনার উল্লেখ করে প্রশ্ন তুলছেন যে কোনওরকম ভেরিফিকেশন ছাড়াই, অর্থাৎ ঘটনার সত্যতা পরীক্ষা নিরীক্ষা না করেই কিভাবে আমাদের দেশের তথাকথিত মেইনস্ট্রিম মিডিয়া ডাক্তার তুষার মেহতার সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টকে ভিত্তি করে সিআইএসএফ এবং দিল্লি বিমানবন্দরের বিরুদ্ধে এই ধরনের চুরির ঘটনার অভিযোগ কে সামনে আনল? তাহলে কি ধরে নিতে হবে আমাদের দেশের মেইনস্ট্রিম মিডিয়া আসলে এক ধরনের সেন্সেশন তৈরি করতে চায়? সত্যের থেকে বহু দূরে সরে গিয়ে কাউকে 'দোষী' এবং কাউকে 'মহাপুরুষ' সাজাতে ব্যস্ত থাকে? দুঃখের বিষয় পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিককালে আরজিকরের দুঃখজনক ঘটনার পরেও আমরা একই ধরনের ঘটনা দেখেছি| সোশ্যাল মিডিয়ায় সংখ্যালঘুদের নিশানা করে পোস্ট হয়েছে আর অন্যদিকে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া সত্য থেকে বহু দূরে সরে গিয়ে সেই খবর প্রচার করেছে!
সুখের বিষয় ডক্টর তুষার মেহতার আষাঢ়ে গল্পের বেলুন ফুটো করে দিয়েছে সিআইএসএস কর্তৃপক্ষ। আর সিআইএসএফ কর্তৃপক্ষ যখন দিল্লি বিমানবন্দরের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ওই সেলিব্রিটি চিকিৎসক যে সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা বলছেন এবং একজন মুসলিম নিরাপত্তা রক্ষীকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন, সেই তথ্যকে যখন সামনে এনেছে, তখন দিল্লি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষও আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি দিয়ে সেই একই কথা জানিয়েছে| কারণ এত যে সে অভিযোগ নয়, দিল্লি বিমানবন্দরে কর্মরত মুসলিম সিআইএসএফ জওয়ান যাত্রীদের ঘড়ি চুরি করছে বলে অভিযোগ! এমনতর অভিযোগ যদি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় তাহলে তো আর সিআইএসএফ এর মতো গুরুত্বপূর্ণ আধা সামরিক বাহিনীতে কোনও সংখ্যালঘুর পক্ষে কাজ করাই মুশকিল হয়ে যাবে! বিমানবন্দরের মত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সিআইএসএফ কিভাবে কাজ করছে, তাই নিয়েই প্রশ্ন চিহ্ন উঠে যাবে। লোকে ভাবতে শুরু করবে, যদি দিল্লি বিমানবন্দরেই যাত্রীদের মালপত্র নিরাপদ না হয়, তাহলে দেশের অন্য বিমানবন্দরেও কি সিআইএসএফ একই ধরনের কান্ড ঘটাতে পারে? সিআইএসএফ এ যেসব মুসলিমরা কাজ করেন, তাঁদের চাকরি শুধু নয়, জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাবে| আমাদের মনে রাখতে হবে সিআইএসএফ হোক, ভারতীয় সেনাবাহিনী হোক, কিংবা বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ ফোর্স, সেখানে সব ধর্মের মানুষ দায়িত্ব সহকারে কাজ করেন। ভারতবর্ষের গণতন্ত্র কোনওদিন এই প্রশ্ন তোলার সুযোগ দেয় না যে 'ও মুসলিম ও কেন বিমানবন্দরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছে' , কিংবা 'ও শিখ ও কেন সীমান্তে বন্দুক হাতে ভারতের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করছে'? এটা ভারতবর্ষের সংস্কৃতি নয়, এটা ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের চরিত্র নয়। স্বয়ং আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবৎ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে ভারতবর্ষকে সমৃদ্ধির পথে এগোতে গেলে হিন্দু মুসলিমের সহাবস্থান এবং সম্প্রীতি রক্ষা জরুরি| কিন্তু ডাক্তার তুষার মেহতা দিল্লি বিমানবন্দরের ঘটনা তুলে মিথ্যে অভিযোগ জানিয়ে ভারতবর্ষের সামাজিক কাঠামোয় আঘাত হানতে চেয়েছিলেন।
ডাক্তার তুষার মেহতা তাঁর মিথ্যে ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর আপাতত সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পালিয়েছেন। কিন্তু অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, কেন মিথ্যে অভিযোগ সাজানোর দায়ে, মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ বা দিল্লী বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে না? এই প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক| ঠিক যেমন প্রশ্ন উঠছে আমাদের দেশের মেইনস্ট্রিম মিডিয়া, যাকে অনেকেই ব্যঙ্গ করে গোদি মিডিয়া বলে ডাকে, তারা কবে থেকে আরেকটু দায়িত্বশীল হবে? সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ পোস্ট করলেন কাকে কান নিয়ে গেছে, আর তারা সেই নিয়ে হইচই জুড়ে সারাদিন ধরে খাপ পঞ্চায়েত বসাবেন, এই প্রবণতা কবে বন্ধ হবে? এটা কি শুধুই ইসলামোফোবিয়া না সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার? দুর্ভাগ্যের বিষয় জাতিবিদ্বেষ ছড়াতে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে দক্ষিণ এশিয়ায় সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে| আর আর সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে বাড়ছে মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় বিদ্বেষের অস্ত্রে, মেরুকরণে শান দেওয়ার প্রবণতা| একজন ডাক্তার, তিনি যত সফলই হোন, যত বড় সেলিব্রিটি হোন,তিনি যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যে লিখে মানুষকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন, বিদ্বেষ এবং ঘৃণাকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেন, কোন নির্দিষ্ট সম্প্রদায় কে নিশানা করেন, তাহলে কেন তার প্রতিবাদ হবে না? ওই ডাক্তারের বিরুদ্ধে পুলিশ কেন ব্যবস্থা নেবে না?