বাঙলা ভাগের সময়ে জ্যোতি বসু কোন দিকে ভোট দিয়েছিলেন, কেন দিয়েছিলেন

 


বাঙলা ভাগের সময়ে জ্যোতি বসু কোন দিকে ভোট দিয়েছিলেন, কেন দিয়েছিলেন– সেসব নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ গোলমাল পাকিয়ে উঠেছে! সবাই নিজের মতো করে বলছেন। কিন্তু পুরো ঘটনার বিশ্লেষণ জানতে চাইলে, বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টির ভোটের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে হবে; নইলে গোটা ঘটনাকে ডানপন্থী ভোটের সাথে গুলিয়ে ফেলে, সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। বিষয়টা বুঝতে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট পার্টির চীনা কমরেডদের একটি ভোটের গল্প জানলে ভালো হয়।


১৯৫০ সালের ভ্যালেন্টাইন ডে’র দিন মাও এর চীন আর স্তালিনের সোভিয়েত রাশিয়া একটি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে; নামে মৈত্রী চুক্তি হলেও আসলে তার মাধ্যমে চীনের কাঁচা মাল আর খনিজের উপর সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রায় একছত্র আধিপত্য কায়েম করে বসে! মাও সব বুঝতে পেরেও ঐ চুক্তিতে সই করেন, তিনি চীনকে মিলিটারি সুপার পাওয়ার করতে চাইছিলেন, তৎকালীন সময়ে সেটা একমাত্র সোভিয়েতরাই করতে পারত! পরবর্তী সময়ে, মাও মারা যাওয়ার পরে, চীনা কমরেডরা ঐ চুক্তিকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শোষণ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন!

কিন্তু মাও যতই চুক্তিতে সই করে আসুন, সেটাতে পার্টির অনুমোদন দরকার ছিল; এইটাই অন্তিম ধাপ। একবার পার্টির অভ্যন্তরীণ ভোটের শিলমোহর পড়ে গেলেই মাও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারতেন।

১১ এপ্রিল ১৯৫০ তারিখে, সেন্ট্রাল পিপল’স গভর্নমেন্ট কাউন্সিলের মিটিং বসেছিল; তাতে মাও নিজের ভাষণে বলেন গোটা চুক্তিতে চীনের খালি লাভ আর লাভ! কিন্তু চুক্তির অ্যাডিশনাল পেপার নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি, সেখানে শুধু রাশিয়ারই লাভ ছিল!


আলোচনার পরে ভোট। হাত তুলে ভোট নেওয়া হল যে, কারা প্রস্তাবের পক্ষে, আর কারা বিপক্ষে বা কারা প্রস্তাব অনুমোদন করছেন না; প্রায় সবাই হাত তুললেন। মানে প্রায় কেউই হাত নামিয়ে রাখলেন না; যাতে মনে হয় যে, তিনি বিপক্ষে বা উক্ত প্রস্তাব অনুমোদন করছেন না। শুধু মাত্র একজন হাত তোলেননি! লোকটা কে? তিনি আর কেউ নন মাও ৎসে-তুং, নিজে!


অবাক কান্ড? মাও কেন হাত তোলেননি? আসলে, মাও জানতেন যে এই চুক্তি চীনের পক্ষে অনেকটাই লোকসানের, তাই তিনি যে প্রস্তাবে শুধুমাত্র পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠের কথাই মানলেন; কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে যে, তার নিজস্ব কোনো মত নেই, সেটার প্রমাণ পার্টির দলিলে রেখেছিলেন!

                                                   *


এবারে জ্যোতি বসু আর রতনলাল, দ্য আপার-কাস্ট! ২০ জুন ১৯৪৭ তারা কী করেছিলেন?

ঐ দিনে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে তিনটি ধাপে ভোট হয়েছিল।

প্রথম ভোট ছিল: অবিভক্ত বাংলা ভারতের তৎকালীন কনস্টিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে যোগ দেবে, না-কি যোগ দিতে চায় না– তাই নিয়ে ভোট হয়।

যদি অবিভক্ত বাংলা, ভারতে যোগ না-দেয়, তাহলে, তাদের জন্যে আলাদা-আলাদা ভাবে, নতুন কনস্টিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি তৈরী হবে।


সেই ভোটের সময় সভায় উপস্থিত ছিলেন স্পিকার নুরুল আলম সহ ২১৯ জন সদস্য। ভোটের ফল ছিল: ৯০-১২৬, এবং ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটের তালিকায় জ্যোতিবাবু বা রতনলাল ব্রাহ্মণের নাম নেই! তারা ভোট দেননি! 


অর্থাৎ যে ৯০ জন সদস্য ভারতের কনস্টিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে যোগ দেওয়ার পক্ষে ছিলেন, তাদের পক্ষে জ্যোতি বসুরা ভোট দেননি! সোজা হিসাবে– জ্যোতি বসুরা অবিভক্ত বাংলা ভারতের তৎকালীন কনস্টিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে যোগ দেবে– এই বিষয়ের পক্ষে ছিলেন না! একই ভাবে তৎকালীন সময়ের প্রায় সব মুসলিম সদস্যও তার পক্ষে ছিলেন না; ফারাক স্রেফ একটাই, তারা বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন; আর জ্যোতি বসুরা পক্ষে ভোট না-দিয়ে নিজেদের বক্তব্য রেখেছিলেন।

 ভোটে ফল হয় ৯০: ১২৬!

[যে ৩ সদস্য ভোট দেননি, তারা কমিউনিস্ট পার্টির; উপরের দু'জন ছাড়াও রূপ নারায়ণ রায় (অবিভক্ত দিনাজপুর জেলা থেকে নির্বাচিত)] 


যেহেতু অবিভক্ত বাংলা ভারতের তৎকালীন কনস্টিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে যোগ দিতে আগ্রহী ছিল না, তাই তাদের আলাদা-আলাদা অংশের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে, নিজস্ব অধিবেশনে আলাদা, আলাদা ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ধাপের ভোটের আয়োজন করা হয়।


দ্বিতীয় ধাপের ভোটের সময়, জ্যোতিবাবু বা রতনলাল ব্রাহ্মণ এই ভোট দেওয়ার অধিকারী ছিলেন না, কারণ তারা মুসলমান গরিষ্ঠ অংশের তরফে নির্বাচিত সদস্য ছিলেন না। ২য় দফার ভোট মুসলিম অংশের এলাকা নিয়েই ছিল। অন্য সদস্য, রূপ নারায়ণ রায়ের এই ২য় দফায় ভোট ছিল, কিন্তু তিনি এই ভোটেও নীরব ছিলেন, পূর্ব দিকের বাংলার অংশ নিয়ে তার কোনো বক্তব্য ছিল না। এমন নয় যে, ঐ অংশের ভারত অন্তর্ভুক্তি নিয়ে প্রতীকী ভোট দিতে পারতেন না; ৩৪ জন ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেটিও করেননি]


একই ভাবে, অমুসলমান প্রধান যে অংশটা বাকি ছিল তাদের নিয়ে তৃতীয় ধাপের ভোট হয়, একই ভাবে দু’টি বিষয়ে ভোট হয়;

ক) বাংলা ভাগ হবে কি-না।

খ) যদি ভাগ হয়, তাহলে উক্ত অংশটি ( এক্ষেত্রে অমুসলিম প্রধান ) পড়ে থাকবে, তারা তৎকালীন ভারতের কনস্টিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে যোগ দেবে কি-না।

দু’টি ভোটেরই ফল হয় ৫৮-২১; জ্যোতিবাবু এবং রতনলাল দু’বারই প্রস্তাবের পক্ষেই ভোট দেন!


কমিউনিস্ট পার্টির লোকজন যুক্তি দেবেন যে, ভারতে অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে তারা কোনো কম্প্রোমাইজ করেননি! কিন্তু ৫৮–২১ ভোটে; দু’টি ভোট কম হলে কী হতো? আগের বারের মতো এবারও বিরত থাকতেই পারতেন। আর যদি নিজেদের বক্তব্য নথিভুক্ত করার এত উৎসাহ থাকে, তাহলে প্রথম ভোটের সময়ে বিরত কেন ছিলেন? তখনও ৯৩ : ১২৬– এই ফলে ভোটে তো কোনো সমস্যা হতো না।


সাদা চোখে, একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে সিগন্যাল দেওয়া ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য তো নজরে আসে না! বক্তব্য খুব সোজা– ভাই, আমাদের কমিউনিস্ট পার্টির কিন্তু তোমাদের অংশের ভারতের দিকে যাওয়া, না-যাওয়া নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই! 


আসল ঘটনা; পার্টি জানত, আজ নয়তো কাল, কাগজ কেউ ঠিকই খুঁজে বার করবেই, তখনের জন্য একটা বিভ্রম তৈরি করে রাখতে হবে।

✍️ এস চক্রবর্তী

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url